রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৯

ফুয়াদ০দিনহীন-এর প্রশ্নের ঊত্তর

(১) মাযহাব, ইজমা, ক্বিয়াস ও ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কেঃ

কোন মানুষ ইসলামের বিধান পেশ করলেই তা গ্রহণ করা যাবে না। ইসলামের নামে যে কোন মতবাদ, তন্ত্র, মন্ত্র গ্রহণ করা যাবে না। কেবল মাত্র আল্লাহ পাকের হাবীব রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া বিধানকেই গ্রহণ করতে হবে। এটাই আল্লাহ পাকের নির্দেশ। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

“আমার রসূল তোমাদের নিকট যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর আর যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক। এ বিষয়ে আল্লাহ পাককে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কঠোর শাস্তিদাতা।” (সূরা হাশর ৭)

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

“হযরত ইরবায বিন সারিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি দুনিয়া হতে বিদায় নেয়ার পর তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি জীবিত থাকবে সে ইসলামের বহু বিষয়ে অনেক ইখতিলাফ বা মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তখন তোমাদের জন্য একান্ত জরুরী হবে আমার সুন্নত এবং খুলাফায়ে রাশিদীনগণের সুন্নতের উপর আমল করা।” (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি শরীয়তের ছহীহ নিয়মের অনুসারী হতে চায় তার জন্য একান্ত কর্তব্য আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে অনুসরণ করা। সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণই উম্মতের মধ্যে অতি উত্তম। তাঁরা আত্মার দিক দিয়ে অতি পবিত্র। ইলমের দিক দিয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। মানুষকে দেখানোর জন্য তাঁরা কোন কাজ করেননি। আল্লাহ পাক তাঁদেরকে মনোনীত করেছেন। আল্লাহ পাক-এর হাবীব হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সোবহত অর্জনের জন্য এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং তোমরা তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হও এবং তাঁদের কথা ও কাজের অনুসরণ কর এবং যথাসম্ভব তাঁদের গুনাবলী ও চরিত্র মুবারককে গ্রহণ করো। কারণ তাঁরা হেদায়েত ও সীরতে মুস্তাকীমের উপর দৃঢ় ছিলেন। ” (মিশকাত শরীফ)

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

“হযরত ইমরান হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে সব চাইতে অতি উত্তম আমার যুগ। অর্থাৎ সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অতি উত্তম। এরপর তাবিয়ীনগণ এবং তারপর তাবি তাবিয়ীনগণ উত্তম।” (বুখারী শরীফ)

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে,

“হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার দর্শনপ্রাপ্ত মুসলামন তথা সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ অথবা সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণকে দর্শনপ্রাপ্ত তাবিয়ীনগণকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা (তিরমিযী, মিশকাত)

হযরত হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই হাদীসের সমর্থনে কুরআন শরীফেও ইরশাদ হয়েছে,

“(ঈমান ও আমলে) সর্বপ্রথম প্রথম স্থান অধিকারী আনছার ও মুহাজির অর্থাৎ হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এবং ইখলাছের সাথে উক্ত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণকারী সকলের প্রতিই আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও তাঁদের অনুসারীদের জন্য এরূপ বেহেশত নির্ধারিত করে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হতে থাকবে, তাঁরা চিরদিন সে বেহেশতে অবস্থান করবেন, যা তাঁদের বিরাট সফলতা।” (সূরা তওবা ১০০)

আল্লাহ পাক এ আয়াত শরীফে স্পষ্টভাষায় জানিয়েছেন যে, ঈমান ও আমলে হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ প্রথম স্থান অধিকার করতঃ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন। তদ্রুপ উত্তমভাবে যারা হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণ করবেন তাঁরাই একমাত্র সঠিক পথে আমল করে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের তাওফীক পাবেন।

স্মরণীয় যে, আল্লাহ পাকের বিধান পালন করাই মূলতঃ মু’মিন ও মুসলমানের কাজ। আল্লাহ পাকের বিধানকে পাওয়া হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়। এই কারণে আল্লাহ পাক নিজেই হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া বিধানকে গ্রহন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আবার হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দেয়া বিধান সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও মুজতাহিদ ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মাধ্যম ছাড়া পাওয়া এবং সঠিকভাবে আমল করা সম্ভব নয়। কারণ এমনও কিছু বিষয় আছে যা ইসলামের প্রথম দিকে নিষিদ্ধ না থাকলেও তা পরবর্তীকালে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন। যেমন- শরাব পান করা। এমনি করে বহু বিষয় আছে যা প্রথমে করা নিষিদ্ধ না থাকলেও তা পরবর্তীকালে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং প্রথম ও পরে কোন সময় কোন হুকুম হয়েছে এটা হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের বর্ণনা ও তাঁদের আমলের মধ্যে পাওয়া যায়।

এ জন্য ইসলামের সঠিক বিধান হিসেবে উত্তমভাবে সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণকারীদেরকে আল্লাহ পাক জান্নাতী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগ থেকে ইসলাম পাবার জন্য মুজতাহিদ ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের অনুসরণ করাটাই বিশেষ গুরুত্বের বিষয়। এর বহু কারণ রয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টি বিষয় হচ্ছে- ১) ইসলামের পূর্বপর বিধান সঠিকভাবে নির্ধারণ ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণই করেছেন। ২) ইসলামী বিধানের মান নির্ধারিত নিয়মে তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত হিসেবে ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মাধ্যমেই পাওয়া যায়যা কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ ও হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস শরীফে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না।

উদাহরণ স্বরূপ- নামাযের কোন কাজটা ফরয, কোনটা ওয়াজিব এবং কোনটা সুন্নত এর বর্ণনা হাদীস শরীফে সরাসরি বলা হয়নি। অথচ সকলেই জানে এবং মানে যে, সব কাজগুলো ফরয নয় অথবা সব কাজগুলো ওয়াজিব বা সুন্নত নয়।

সুতরাং ইসলামের পূর্বপর বিধানকে যেমন সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মাধ্যমে পাবার জন্য তাবিয়ীন এবং তাবি তাবিয়ীন তথা মুজতাহিদ ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের বর্ণনা থেকেই গ্রহন করতে হবে। একইভাবে, ইসলামী বিধানের মান নির্ধারণ করে আমল করার জন্য মুজতাহিদ ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের অনুসরণ ব্যতীত দ্বিতীয় কোন পথ নেই।

ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তাবিয়ী ছিলেন। তিনি সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের দর্শন লাভ করে ইসলামের সর্ববিধ বিষয় শিক্ষা গ্রহন করেন। সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ছাড়া তাবিয়ীনদের থেকেও ইসলামী বিধানের শিক্ষা গ্রহন করেন। মাযহাবের ইমাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মধ্যে একমাত্র তিনিই তাবিয়ী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

পৃথিবীতে যদি অনুসন্ধান করা হয়, তবে দেখা যাবে যে, বর্তমানে আহলে সুন্নত ওয়াক জামায়াতই একমাত্র সঠিক মু’মিন ও মুসলমান। আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঠিক ইসলামের উপর চলার যে নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেটা একমাত্র আহলে সুন্নত ওয়াক জামায়াতের লোকেরাই অনুসরন করে চলে। ইসলামের নামে অন্য যারা পরিচয় দিচ্ছেন তারা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিধান গ্রহণ করছেনা। যেমন- কাদিয়ানী, বাহাই, খারিজী, রাফিজী, মুতাজিলা, লা-মাযহাবী, সালাফী ইত্যাদি ৭২ ফিরক্বাহ।

উল্লেখ্য, ইসলামের শত্রুপক্ষ সর্বদাই মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কুরআন শরীফ ও নবী পাকের অস্তিত্বকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য যেমন কাদিয়ানী সম্প্রদায় আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, তদ্রুপ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অস্তিত্ব মিটিয়ে দেয়ার জন্য এক শ্রেণীর লোক যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলছে। কারণ, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত সম্পর্কে যদি লোক সমাজে কু-ধারণা সৃষ্টি করা যায়, তবেই মানুষকে পথভ্রষ্ট করা সহজ।

বর্তমানে বিশ্বে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীগণ চার মাযহাবেরই অন্তর্ভূক্ত। হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী। পৃথিবীতে হানাফী মাযহাবের লোক বেশী। বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশে হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্য মাযহাবের অনুসারী নাই বললেই চলে। এই কারণে ইসলামের শত্রুপক্ষ সর্বদাই হানাফী মাযহাবের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। কাগজপত্রে কখনও লিখছে যে, মাযহাবে বিশ্বাসী হলে কাফির হবে, ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি কাফির ছিলেন। (নাঊযুবিল্লাহ)হানাফী মাযহাব বলে কিছু নেই, হানাফীদের কোন আমল ঠিক নয় ইত্যাদি। ঈমানের পর যেহেতু নামাযের গুরুত্ব- এই কারণে হানাফীদের নামায সম্পর্কে বহু ভূল লিখা ছাপিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে।

তবে সর্বসস্মত কথা এই যে, কেউ যদি সঠিকভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আইন বা জীবনব্যবস্থা খোঁজ করে তবে তার হানাফী মাযহাবের ফিক্বাহ শাস্ত্রের সাহায্য নিতে হবে এবং হানাফী মাযহাবের ফিক্বাহ শাস্ত্রের কিতাবেই তা পাওয়া যাবে। হানাফী মাযহাব কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের সঠিক বিধান বাহক তাবিয়ীন ও তাবি তাবিয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের মাধ্যমে সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ কতৃক সংরক্ষিত ইসলামী বিধানের অনুসরণ করার নাম।

সুতরাং তথাকথিত আহলে হাদীস, লা-মাযহাবী, সালাফী ইত্যাদি কুচক্রী মহলের কলমে হানাফী মাযহাব, ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হানাফীদের বিরুদ্ধে যা লিখা হয়েছে সবই ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের শামীল।

কুরআন শরীফের দৃষ্টিতে মাযহাব গ্রহন করা ফরয-ওয়াজিবঃ

আল্লাহ পাক তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন,

“হে ঈমানদারগণ! তোমারা আল্লাহ পাকেরের ইতায়াত করো এবং আল্লাহ পাকের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করো এবং তোমাদের মধ্যে যারা উলিল আমর রয়েছে তাঁদের ইতায়াত করোঅতঃপর যদি কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় তাহলে তা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। অর্থাৎ যেই উলিল আমর আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বেশী অনুগত ও নৈকট্যশীল বা যার মতের স্বপক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর দলীল-আদিল্লাহ বেশী রয়েছে তাঁকে বা তাঁর মতকে অনুসরণ করবে। যদি তোমারা আল্লাহ পাক ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে থাক। এটাই কল্যাণকর এবং তা’বিল বা ব্যাখ্যার দিক দিয়ে উত্তম।” (সূরা নিসা ৫৯)

কুরআন শরীফের এ আয়াত শরীফের মধ্যে আল্লাহ পাক বান্দার জন্য ইতায়াত বা অনুসরণের কাইফিয়াত ও তরতীব বর্ণনা করেছেন।

প্রথমতঃ আল্লাহ পাক-এর ইতায়াতের কথা বলা হয়েছে। তা তো কেবল নবী-রসূল আলাইহিমুছ ছালাত ওয়াস সালামগণের পক্ষেই সম্ভব। কারণ তাঁদেরকেই আল্লাহ পাক ওহী নাযিলের মাধ্যমে সবকিছু জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ করেন,

“আমি তাঁদের প্রতি ওহী নাযিল করতাম।” (সূরা ইউসূফ ১০৯, সূরা নহল ৭৪, সূরা আম্বিয়া ৭)

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ পাকের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াতের কথা বলা হয়েছে। এটা তো হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের জন্যই খাছ। কারণ, আল্লাহ পাকের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁরাই দেখেছেন এবং তাঁর কাছ থেকে ওহীর ইলম জেনে, শুনে, বুঝে আমল করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে,

“যে ব্যক্তি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইতায়াত করলো সে মূলতঃ আল্লাহ পাক-এরই ইতায়াত করলো।” (সূরা নিসা ৮০)

তৃতীয়তঃ উলিল আমরের ইতায়াতের কথা বলা হয়েছে। এটাই মূলতঃ পরবর্তীলালের উম্মতের জন্য নির্ধারিত বিধান। এ প্রসঙ্গে কুরআন শরীফের উল্লিখিত আয়াত শরীফসহ আরো বহু আয়াত শরীফ ইরশাদ হয়েছে। যেমন কুরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

“তোমরা ঈমান আনো যেরূপ হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ঈমান এনেছেন।” (সূরা বাক্বারা ১৩)

“(ঈমান ও আমলে) সর্বপ্রথম প্রথম স্থান অধিকারী আনছার ও মুহাজির অর্থাৎ হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ এবং ইখলাছের সাথে উক্ত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণকারী সকলের প্রতিই আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ ও তাঁদের অনুসারীদের জন্য এরূপ বেহেশত নির্ধারিত করে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত হতে থাকবে, তাঁরা চিরদিন সে বেহেশতে অবস্থান করবেন, যা তাঁদের বিরাট সফলতা।” (সূরা তওবা ১০০)

“যে ব্যক্তি রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণ করে, তার কাছে সঠিক পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মু’মিনণের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐদিকেই ফিরাবো যে দিকে সে রুজু হয় এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর জাহান্নাম নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।” (সূরা নিসা ১১৫)

এখানে মু’মিনণের পথ বলতে হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের পথ, অতঃপর তাবিয়ীন, তাবি তাবিয়ীন ও মুজতাহিদ ইমাম ও আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের পথকে বুঝানো হয়েছে।

আল্লাহ পাক সূরা ফাতিহার মধ্যে সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দান করে সে পথে চলার জন্য দু’য়া শিক্ষা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে,

“আয় বারে ইলাহী! আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শণ করুন। তাঁদের পথ যাদেরকে আপনি নিয়ামত দান করেছেন।” (সূরা ফাতিহা ৫-৬)

কাদেরকে নিয়ামত দেয়া হয়েছে সে প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে,

“আল্লাহ পাক নিয়ামত দান করেছেন- নবী, ছিদ্দীক্ব, শহীদ ও ছালিহগণকে এবং তাঁরাই উত্তম বন্ধু বা সঙ্গী।” (সূরা নিসা ৬৯)

আল্লাহ পাক সূরা ফাতিহার মধ্যে নবী, ছিদ্দীক্ব, শহীদ ও ছালিহগণের পথ তলব করতে বলেছেন এবং তাঁদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করতে বলেছেন। অর্থাৎ এখানে দেখা যাচ্ছে, পথ হচ্ছে দু’টি। প্রথমতঃ নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথ। দ্বিতীয়তঃ ছিদ্দীক্ব, শহীদ ও ছালিহগণের পথ তথা উলিল আমরগণের পথ।

উল্লেখ্য, উলিল আমরগণের মধ্যে প্রথম স্তরের উলিল আমর হচ্ছেন হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ। তাঁরা প্রত্যেকেই উম্মাহর জন্য অনুসরনীয়, অনুকরণীয় ও পথপ্রদর্শক ছিলেন।

আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন,

“যদি তোমরা না জান তাহলে আহলে যিকিরগণের নিকট জিজ্ঞাসা করে কেনে নাও।” (সূরা আম্বিয়া ৭)

অত্র আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন- “আমরা সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণই আহলে যিকিরের অন্তর্ভূক্ত।” (তাফসীরে কুরতুবী)

অর্থাৎ আল্লাহ পাক নিজেই উম্মাহর জন্য কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ বুঝতে ও আমল করতে উলিল আমরগণের অর্থাৎ সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং মুজতাহিদ ইমাম ও আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের ইতায়াত ও পায়রবী করাকে ফরয-ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছেন। বিশেষ করে হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের জামান অতীত হওয়ার পর উম্মাহর জন্য মাযহাবের চতুষ্ঠ্যের ইমামগণের অনুসরণ ব্যতীত কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ মুতাবিক আমল করা সম্ভব নয়। কারণ, এই ইমাম ব্যতীত আর কেউই শরীয়তের যাবতীয় মাসায়ালা-মাসায়িল লিপিবদ্ধ করেননি।

কাজেই। শরীয়তের প্রতি আমল করতে গেলে এই চার ইমামের একজনকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। এটা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। যদি কোন মাযহাব মান্য করা না হয় তাহলে শরীয়ত থেকে খারিজ হয়ে যাবে।

হাদীস শরীফের দৃষ্টিতে মাযহাব গ্রহন করা ফরয-ওয়াজিবঃ

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি শরীয়তের সঠিক তরীক্বা অনুসরণ করতে চায়, তার উচিত হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর প্রিয় হযরত সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের অনুসরণ করা। সাহাবা--কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণই উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম, তাঁরা আত্মার দিক দিয়ে অধিক পবিত্র, ইলমের দিক দিয়ে গভীর ইলমের অধিকারী, তাঁরা লোক দেখানো কোন আমল করতে জানেনা, আল্লাহ পাক তাঁদেরকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম –এর সাথী হিসেবে মনোনীত করেন। সুতরাং তাঁদের মর্যাদা-মর্তবা, ফাযায়েল-ফযীলত, শান-শওকত সম্পর্কে অবগত হও এবং তাঁদের কথা ও কাজের অনুসরণ কর এবং যথাসম্ভব তাঁদের সীরত-ছুরতকে গ্রহণ কর, কারণ তাঁরা হিদায়েত ও সিরাতুল মুস্তাকীন –এর ঊপর দৃঢ়চিত্ত ছিলেন।” (মিশকাত শরীফ)

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্‌ফাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাকের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমার সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সম্পর্কে আল্লাহ পাককে ভয় কর, আমার সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সম্পর্কেআল্লাহ পাককে ভয় কর আমার পরে তাঁদেরকে তিরস্কারের লক্ষ্যস্থল করোনা। তাঁদেরকে যারা মহব্বত করলো, তা আমাকে মহব্বত করার কারণেই। এবং তাঁদের প্রতি যারা বিদ্বেষ পোষণ করলো, তা আমাকে বিদ্বেষ পোষণ করার কারণেই। তাঁদেরকে যারা কষ্ট দিল, তারা আমাকে কষ্ট দিল, তারা আল্লাহ পাককেই কষ্ট দিল। আর যারা আল্লাহ পাককে কষ্ট দিল, তাদেরকে আল্লাহ পাক অতি শীঘ্রই পাকড়াও করবেন।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ)

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্‌ফাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আল্লাহ পাকের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে নামায পড়লেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে এমন মর্মস্পর্শী নছীহত করলেন যাতে আমাদের চক্ষুসমূহ অশ্রুসিক্ত এবং অন্তরসমূহ বিগলিত হলো। এ সময় একজন সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলে উঠলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এটা যেন বিদায় গ্রহণকারীর শেষ নছীহত। আমাদেরকে আরো কিছু নছীহত করুন। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদেরকে আমি আল্লাহ পাককে ভয় করা এবং তোমাদের ইমাম বা উলিল আমরের কথা মান্য করা এবং তাঁর অনুগত থাকার জন্য নছীহত করছি যদিও তিনি হাবশী গোলাম হন। আমার বিদায়ের পর তোমদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে সে অনেক ইখতিলাফ বা মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমারা আমার সুন্নতকে এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রশিদীনের সুন্নতকে মাড়ির দাঁত দ্বারা শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধরবে।” (আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

“হযরত উমর ইবনুল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমার পর আমার সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইখতিলাফ (মতবিরোধ) সম্পর্কে আমি আল্লাহ পাককে জিজ্ঞাসা করেছি।’ আল্লাহ পাক আমাকে বললেন, ‘হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! নিশ্চয়ই আপনার সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ আমার নিকট তারকা সমতুল্য। প্রত্যেকেরই নূর রয়েছে। তবে কারো নূরের চেয়ে কারো নূর বেশী। সুতরাং, তাদের যে কোন ইখতিলাফকে যারা আঁকড়িয়ে ধরবে, তারা হিদায়াত পেয়ে যাবে। কারণ তাঁদের ইখতিলাফগুলো আমার নিকট হিদায়াত হিসাবে গণ্য।’ অতঃপর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমার সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ প্রত্যেকেই তারকা সাদৃশ্য, তাঁদের যে কাউকে তোমারা অনুসরণ করবে, হিদায়াত প্রাপ্ত হবে’ (মিশকাত শরীফ)

হাদীস শরীফের উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত বর্ণনার দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, উলিল আমরের অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করা এবং কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়ত মুতাবিক চলা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।

আরো প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রত্যেক সাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর প্রদর্শিত বা অনুসৃত পথই সতন্ত্র একটা মাযহাব ছিলো। যার অনুসরণে হযরত তাবিয়ীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ চলতেন।

কিন্তু তাবিয়ীনে কিরাম এবং তাবি তাবিয়ীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের যুগ অতিবাহিত হওয়ার শেষ দিকে অর্থাৎ দু’শত হিজরীর পর ইমাম-মুজতাহিদ্গণ অনুসন্ধান করে দেখলেন যে, কেবলমাত্র চার ইমামের মধ্যেই দ্বীনের পরিপূর্ণ মাসায়ালা রয়েছে। তাই তাঁরা এ ফতওয়া উপর ইজমা বা ঐক্যবদ্ধ হলেন যে, চার মাযহাবের যে কোন এক মাযহাব অনুসরণ করা ফরয-ওয়াজিব।

হাদীস শরীফে রয়েছে,

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ পাকের রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইলম তিন প্রকার। এক- আয়াতে মুহকামাহ, দুই- সুপ্রতিষ্ঠিত সুন্নতসমূহ, তিন- ফরীদ্বায়ে আদিলাহ বা ন্যায়সঙ্গত ফরযসমূহ। ইহা ব্যতীত যা রয়েছে তা অতিরিক্ত।” (আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

মূলতঃ মাযহাবের ইমামগণের অনুসরণ এবং ত্বরীক্বার ইমামগণের অনুসৃত পথের অনুসরণই হচ্ছে হাদীস শরীফে বর্ণিত ফরীদ্বায়ে আদিলাহ অন্তর্ভূক্ত।

ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহগণের দৃষ্টিতে মাযহাব গ্রহন করা ফরয-ওয়াজিবঃ

‘মুসাল্লামা’ কিতাবে আছে, “যে ব্যক্তি মুজতাহিদ (মতলক্ব) নয় যদিও সে আলিম, তথাপি তা জন্য তাক্‌লীদ অর্থাৎ কোন এক মাযহাবের অনুসরণ করা ফরয।”

হযরত মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “সাধারণের জন্য আলিমগণকে এবং আলিমদের জন্য মুজতাহিদগণকে অনুসরণ করা ওয়াজিব।”

তিনি আরো বলেন, “চার মাহাবের কোন একটাকে অনুসরণ করা ওয়াজিব।” (তাফসীরে আহ্‌মদিয়াত)

হযরত আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “যারা মুজতাহিদ (মতলক্ব)-এর ক্ষমতা রাখে না, তাদের কোন এক ইমামের মাযহাব অনুসরণ করা ওয়াজিব।” (জামউল জাওয়াম)

হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “কোন এক মাযহাবের অনুসরণ করা ওয়াজিব।” (ইহ্‌ইয়াউ উলুমিদ্দীন)

এছাড়াও হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি “আল মালুম” কিতাবে, হযরত আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি “যাজিযুল মাযাহিব” কিতাবে, হযরত আল্লামা বাহারুল উলূম রহমতুল্লাহি আলাইহি “তাহ্‌‌রির” কিতাবে, হযরত আল্লামা ইবনে আব্দুর নূর রহমতুল্লাহি আলাইহি “হারী”কিতাবে, হযরত শাহ্‌ ওয়ালীউল্লাহ্‌ মুহাদ্দিস দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি “ইকদুল জিদ”“ইনছাফ” কিতাবে, “তাফসীরে আযীযী”, “সিফরুছ সায়াদাত” কিতাবে, “ফয়জুল হারামাইন” কিতাবে কোন এক মাযহাবের অনুসরণে চলা ওয়াজিব বলা হয়েছে, অন্যথায় গুনাহ হবে হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর “কিমিয়ায়ে সায়াদাত” কিতাবে বলেন, “কোন এক মাযহাব মান্য না করলে মহাপাপী হবে।”

অতএব, প্রমাণিত হলো প্রত্যেকের জন্য মাযহাব চতুষ্ঠের যে কোন এক মাযহাবের অনুসরণ করা ফরয-ওয়াজিব। অন্যথায় সে ফাসিক ও গোমরাহ হবে, এর উপরই ইমাম-মুজতাহিদ্গণের ইজমা হয়েছে।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন এলাকা বিশেষ করে সৌদি আরবে যারা সালাফী নামে পরিচিত তারাও মাযহাব স্বীকার করে না। বরং মাযহাবের বিরোধীতা করেযারা মাযহাব মানে না বা মাযহাবের বিরোধীতা করে তারা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- ওহাবী, সালাফী, মুহম্মদী, লা-মাযহাবী, আহলে হাদীস, রফে ইয়াদাইন ইত্যাদি। তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের বিপরীত মত-পথ পোষণ ও প্রচার করে। তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্য থেকে ইমাম বানিয়ে তার অনুসরণ করে। তাদের ইমামের আক্বীদা-আমল কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ হলেও সেটাই তারা অনুসরণ করে। (নাঊযুবিল্লাহ)

উল্লেখ্য যারা মাযহাব মানে না তারা কয়েক শ্রেণীর-

১) প্রথম শ্রেণী যারা মুশাব্বিহা ফিরক্বার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করে। তারা বিশ্বাস করে, আমাদের মতো আল্লাহ পাকের হাত, পা, চোখ, কান যবান ইত্যাদি রয়েছে।

২) দ্বিতীয় শ্রেণী যারা বলে, মাযহাব মানা শির্‌ক।

৩) তৃতীয় শ্রেণী যারা বলে, মাযহাব মানা বিদায়াত।

৪) চতুর্থ শ্রেণী যারা মাযহাবকে হক্ব বা সঠিক বলে জানে। তারা যদিও প্রকাশ্যে নিজেদেরকে মাযহাবের অনুসরণকারী বলে দাবী করে না, প্রকৃতপক্ষে তারা চার মাযহাবের কোন একটি মাযহাব অনুযায়ী আমল করে বা তার অনুসারী।

এ চার শ্রেণীর মধ্যে শুধুমাত্র শেষ শ্রেণী ব্যতীত বাকী তিন শ্রেণীই নাহক্ব।

মাযহাব অস্বীকার করা মানে ইজমা-ক্বিয়াস অস্বীকার করাঃ

আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মতে শরীয়তের কোন বিষয়ে মীমাংসা বা ফায়সালা করতে হলে তা কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতেই করতে হবে। এর বাইরে কোন কথা বা কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা শরীয়তের ভিত্তি বা দলীলই হলো উপরোক্ত চারটি।

এ প্রসঙ্গে উছূলের কিতাবে উল্লেখ আছে,

“মূলতঃ শরীয়তের ভিত্তি হলো তিনটি। কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা এবং চতুর্থ হলো ক্বিয়াস।” (নূরুল আনওয়ার)

ইজমাঃ যে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে স্পষ্ট কোন কিছু বলা হয়নি, সে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করতঃ হুকুম ছাবিত করতে হবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনীয়তায় এ ধরনের ইজতিহাদ করা আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই নির্দেশ। যেমন, কালামে পাকে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

“হে চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর ২)

আর আল্লাহ পাকের হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রদ্বিয়ালাহু তায়ালা আনহুকে ইয়মেনের গভর্নর করে পাঠনোর সময় বলেছিলেন,

হে মুয়ায! তোমার নিকট কোন মুকাদ্দমা আসলে তা কিভাবে ফায়সালা করবে? জবাবে হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রদ্বিয়ালাহু তায়ালা আনহু বললেন, আল্লাহ পাকের কিতাবের দ্বারাযদি তাতে না পাও তাহলে? আল্লাহ পাকের হাবীব হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ দ্বারাঅতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, যদি তাতেও না পাও তাহলে? আমি কুরআন ও সুন্নাহ্ -র ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে রায় দেবএ উত্তর শুনে হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রসংশা ঐ আল্লাহ পাকের, যিনি তাঁর রসূলের দূতকে এ যোগ্যতা দান করেছেন, যাতে তাঁর রসূল সন্তুষ্ট হন (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ)

এ হাদীস শরীফ দ্বারা স্পস্ট প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের কল্যাণার্থে ও কুরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করা হাদীসর শরীফে নির্দেশ আছে

উল্লেখ্য, যে ইজতিহাদকৃত মাসয়ালা এককভাবে রয়েছে সেটাকে ক্বিয়াস বলে আর ইজতিহাদকৃত মাসয়ালাগুলোর মধ্যে যেগুলোর উপর মুজতাহিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন, শরীয়তে সেগুলোকে ইজমা বলে

ইজমা-এর দলীল সম্পর্কে শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম, ইমামুল আইম্মাহ, হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “কুরআন শরীফ থেকে ইজমা-এর দলীল বের করতে আমি ৩দিনে ৯বার কুরআন শরীফ খতম করি।” অন্য বর্ণনায় ৩০০বার কুরআন শরীফ খতম করি। অতঃপর আমি নিশ্চিত হই যে, নিম্নোক্ত আয়াত শরীফখানাই ‘ইজমা’-এর দলীল।” যেমন, ইরশাদ হয়েছে,

“কারো নিকট হিদায়েত বিকশিত হওয়ার পরও যদি সে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর বিরূদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনণের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথের অনুররণ করে, তবে আমি তাকে সে দিকেই ফিরাবো, যে দিকে ফিরেছে।” (সূরা নিসা ১১৫)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ইজমা শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তা অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য।

ক্বিয়াসঃ ক্বিয়াস মূলতঃ নতুন কোন বিষয় নয়, বরং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ক্বিয়াস করেছেন। তার প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ-

“হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট এসে বললেন- ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার ভগ্নি হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু আদায় করার পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার ভগ্নির উপর কোন ঋণ থাকলে তুমি তা আদায় করতে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে আল্লাহ পাকের হক্ব আদায় কর। কেননা এটা আদায় করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)

আখেরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণও ক্বিয়াস করে সমস্যার সমাধান করতেন। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে,

“তাবিয়ী হযরত মুহম্মদ ইবনে সীরীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট কোন মুকাদ্দমা আসলে, প্রথমে কুরআন-সুন্নাহর প্রতি নিজর দিতেন, সেখানে যদি কোন নির্দেশনা না পেতেন, তাহলে নিজের রায় অনুযায়ী ইজতিহাদ বা ক্বিয়াস করে নিতেন।” (আত্‌ তবাকাতুল কুবরা লি ইবনে সা’দ)

অনুরূপ হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নীতি ছিল যে, তিনি ফায়সালা করার ক্ষেত্রে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর পর হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর রায়ের প্রতি নজর দিতেন, সেখানেও না পাওয়া গেলে বলতেন, فِيْهِ بِرَاْيِيْ (অর্থাৎ নিজের রায় মোতাবেক ফায়সালা করতেন)। (দারিমী, মুস্তাদারিকে হাকিম)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, ক্বিয়াস শুধু শরীরতের অকাট্য দলীলই নয় বরং ক্বিয়াসের মাধ্যমে মাসায়ালা ছাবিত করা আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের খাছ সুন্নাত।

সুতরাং ক্বিয়াসের অনুসরণ করাও আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়, ক্বিয়াসের প্রতি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতগণকে উৎসাহিতও করেছেন। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে-

“হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন কোন ফায়সালাকারী ফায়সালা করবে, সে যদি কামিয়াব হয়, দ্বিগুণ ছওয়াব পাবে। আর যদি সে ভূল করে, তাহলে একগুণ ছওয়াব পাবে।” (বুখারী শরীফ)

উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়াস কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত এবং তা শরীয়তের অকাট্য দলীলরূপে পরিগণিত। সুতরাং ক্বিয়াস অনুসরণ করার অর্থই হলো- কুরআন-সুন্নাহকে অনুসরণ করা। আর ক্বিয়াসের বিরোধীতা করা, কুরআন-সুন্নাহ অস্বীকার করারই নামান্তর।

ইমাম-মুজতাহিদ্গণের একটি ক্বিয়াসের উদাহরণঃ

কুরআন শরীফের আয়াত শরীফের আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ اُمَّهَتُكُمْ وَبَنٰتُكُمْ

অর্থঃ- “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মাতা ও কন্যাদেরকে।” (সূরা নিসা ২৩)

এখানে اُمَّهَاتُ শব্দের দ্বারা মাতাকে বিবাহ হারাম বুঝায়। শরীয়তে নানী, দাদী বা নাত্নীকে বিবাহ করা হারাম, কিন্তু কুরআন শরীফ বা হাদীস শরীফের কোথাও নানী, দাদী বা নাত্নীকে বিবাহ করা হারাম তার প্রকাশ্য কোন ইবারত নেই।

সুতরাং যারা ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে বা কুরআন-হাদীস ব্যতীত অন্য কোন ইজতিহাদী ক্বওল গ্রহন করতে নারাজ, তারা এ ব্যপারে কি মত গ্রহণ করবে? ক্বিয়াস অস্বীকার করে নানী, দাদী বা নাত্নীকে বিবাহ করবে? নাকি ক্বিয়াস স্বীকার করে হারাম হতে নিজেকে রক্ষা করবে?

স্মর্তব্য যে, উক্ত আয়াতের اُمَّهَاتُ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত,তাই মুজতাহিদ তথা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলিহিমগণ মাতার সাথে ক্বিয়াসের দ্বারা উর্ধ্বতন যত নারী (যেমন নানী, দাদী, তার মা, প্রমূখ সকলেই) এবং بَنٰتُكُمْ শব্দটি দিয়ে নিম্ন সারীর যত নারী (যেমন মেয়ে, নাত্নী, প্রো নাত্নী প্রমূখ সকলেই)দেরকে বিবাহ করা হারাম সাব্যস্ত করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, এই ক্বিয়াস হানাফী, মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী চার মাযহাবেরই রায়। তাই এখন যদি কেউ ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে ও মাযহাবের বিরুদ্ধে মত পোষণ করে, তা গোমরাহীর বৈ আর কিছু নয়। কাজেই, কোন বিষয়ে শরয়ী ফায়সালা করতে হলে, প্রথমে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের দ্বারাই তা করতে হবে। কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে যদি তার সুস্পষ্ট বিধান পাওয়া না যায়, তবে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইজমা-ক্বিয়াসের দ্বারা তার ফায়সালা করতে হবে। কেননা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের দলীলের ভিত্তিই হলো উক্ত চারটি। এর বাইরে কোন কিছুই গ্রহনযোগ্য নয়।

অতএব, ইমামগণের মত ও সমাধান বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ শরীয়ত পালন করা আদৌ সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, কুরআন শরীফের ব্যাখ্যাই হাদীস শরীফ এবং কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের ব্যাখ্যাই ইজমা ও ক্বিয়াস। ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হলে এবং শরীয়তকে পরিপূর্ণরূপে পালন করতে হলে চারজন ইমামের প্রবর্তিত চারটি মাযহাবের মধ্যে যে কোন একটির অনুসরণ করতেই হবে। সেজন্য শরীয়ত পালনকারী মাত্রই মাযহাবী হোন আর লা-মাযহাবী হোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে যে কোন এক জন ইমামের মত অবশ্যই মেনে চলছেন। এতদ্‌সত্তেও এটা যারা অস্বীকার করে, তারা জাহিল ও গোমরাহ। কেননা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ মানাই মাযহাব মানা, আর মাযহাব মানার অর্থই কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ মানা তথা ইসলামী শরীয়ত পালন করা।

কাজেই, মাযহাবের বিরোধীতা করা কুফরী। আর যে কুফরী করে যে ইসলাম ও মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে মুরতাদ ও কাফিরে পরিণত হয়।

উপরে মাযহাব মানা ফরয এবং মাযহাব অস্বীকার করা বা মাযহাবের বিরোধিতা করা কুফরী সে বর্ণনার পাশাপাশি হানাফী মাযহাবের ইমাম ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং প্রতিষ্ঠিত হানাফী মাযহাব সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। মূলতঃ ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ছানা-সিফত বেমেছাল। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। সকলেই তাঁকে ইমামে আ’যম হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তাঁর বেমেছাল বুযুর্গী সম্মানের কারণে প্রায় সমস্ত ইমাম-মুজতাহিদ ও আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ তো বটেই এমনকি আন্যান্য মাযহাবের ইমাম পর্যন্ত তাঁর মর্যাদার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

যেমন- মালিকী মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি এমন এক ব্যক্তি তিনি একটা কাঠের খুঁটিকে যদি স্বর্ণের খুঁটি বলে দলীল-প্রমাণ পেশ করেন, পৃথিবীর কোন ব্যক্তির সাধ্য নেই যে, উক্ত খুঁটিকে সে কাঠের খুঁটি প্রমাণ করতে পারে।” (সুবহানাল্লাহ)

শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “সমস্ত ফক্বীহগণ ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর কাছে সন্তানতুল্য।” (সুবহানাল্লাহ)

বর্ণিত রয়েছে, হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন কোন মাসায়ালার বিষয়ে সমস্যার সম্মুখিন হতেন তখন তিনি ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মাযার শরীফে এসে যিয়ারত করে সেখানে হানাফী মাযহাব মুতাবিক দু’রাকায়াত নামায পড়তেন। অতঃপর ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ওসীলা দিয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে তাঁর সমস্যা জানাতেন। আল্লাহ পাক সাথে সাথে তাঁর দু’য়া কবুল করতেন। অর্থাৎ মাসায়ালার যে সমস্যার জালে আবদ্ধ হয়ে তিনি সেখানে যেতেন ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ওসীলার বরকতে তা খুলে যেত। অতঃপর সুদূর বাগদাদ শরীফে থেকে স্বীয় স্থানে ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন করতেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজেই বলেন,

“নিশ্চয়ই আমি ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বরকত হাছিল করি। আমার যখন কোন সমস্যা দেখা দেয় তখন তাঁর মাযার শরীফে এসে প্রথমে দু’রাকায়াত নামায আদায় করি। অতঃপর তাঁর ওসীলা দিয়ে আল্লাহ পাকের দরবারে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রার্থনা করি। অতঃপর অতি সত্ত্বর তার সমাধান হয়ে যায়।” (মুকাদ্দিমা, শামী ১ম খন্ড, ৫৫ পৃষ্ঠা)

ক্বাদিরিয়া ত্বরীকার ইমাম সাইয়্যিদুল আউলিয়া হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি হাম্বলী মাযহাবের মুকাল্লিদ হওয়া সত্ত্বেও হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ হওয়ার জন্য ইরাদা বা ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।

চীশতিয়া ত্বরীকার ইমাম সুলত্বানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ হাবীবুল্লাহ হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চীশতি রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন হানাফী মাযহাবের অনুসারী।

নকশ্‌বন্দিয়া ত্বরীকার ইমাম খাজায়ে খাজেগাঁ হযরত সাইয়্যিদ বাহাউদ্দীন মুহম্মদ নকশ্‌বন্দ বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।

নকশ্‌বন্দিয়া মুজাদ্দিদিয়া ত্বরীকার ইমাম আফযালুল আউলিয়া হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ হওয়ার কারণে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করেন এবং হানাফী মাযহাবের বৈশিষ্ট উল্লেখ করে বলেন, “যখন ইমাম মাহদী আলাইহিস্‌ সালাম প্রকাশ হবেন তাঁর হিদায়েতের কাজে সহায়তা করার জন্য জলীলুর ক্বদর রসূল হযরত ঈসা আলাইহিস্‌ সালামকে পাঠানো হবে। তিনি যেহেতু জলীলুর ক্বদর নবী ও রসূল যার কারণে তিনি কোন মাযহাব অনুসরন করে চলবেন না বরং নিজেই ইজতিহাদ করে চলবেন। কিন্তু দেখা যাবে তাঁর ইজতিহাদ আর ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ইজতিহাদ এক হয়ে যাবে, যার ফলে লোকজন তাঁকে হানাফী মাযহাবের মুকাল্লিদ বলে মনে করবে। (সুবহানাল্লাহ)

পৃথিবীর ইতিহাসে যাঁরা প্রথম শ্রেণীর মুহাদ্দিছ তাঁদের একজন হচ্ছেন ইমামুল মুহাদ্দিছীন ফক্বীহুল উম্মত হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী হওয়ার কারণে নিজেকে ধন্য মনে করেন।

(২) “গাউছুল আ’যম” লক্বব সম্পর্কেঃ

“গাউছুল আ’যম” শব্দটির মতো আরো শত-সহস্র শব্দ কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসে রয়েছে যার সরাসরি শাব্দিক অর্থ গ্রহন করলে কুফরী হয়।

যেমন, (مَكَر) শব্দের অর্থ ধোকা। আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,

مَكَرُوْا وَمَكَرَ اَللهُ وَاَللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِيْنَ٭

অর্থঃ- “তারা (কাফিররা) ধোকাবাজী করলো, আল্লাহ পাক প্রজ্ঞা অবলম্বন করলেন, আল্লাহ পাক সর্বত্তোম প্রজ্ঞা অবলম্বনকারী।”

(সূরা আলে ইমরান ৫৪)

এখানে আল্লাহ পাকের শানে (مَكَر) শব্দের শাব্দিক অর্থ গ্রহন করলে আল্লাহ পাককে সর্বত্তোম ধোকাবাজ বলতে হয় অথচ এটি সুস্পষ্ট কুফরী।

বরং এখানে আল্লাহ পাকের শানে (مَكَر) শব্দের অর্থ গ্রহন করতে হবে সর্বত্তোম প্রজ্ঞা অবলম্বনকারী।

ঠিক একইভাবে যদি আল্লাহ পাকের গুণ লক্বব বা উপাধী হিসেবে ব্যবহার করলে আল্লাহ দাবী করা হয় তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, তৃতীয় খলীফা হযরত উছমান যিন্‌ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু আল্লাহ দাবী করেছেন। কারণ মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,

وَاَللهُ الْغَنِيُّ وَاَنْتُمُ الْفُقَرَآءُ٭

অর্থঃ- “মহান আল্লাহ পাক ধনী আর তোমারা ফকির।”

(সূরা মুহম্মদ ৩৮)

এ আয়াত শরীফে আল্লাহ পাক নিজেকে (الْغَنِيُّ) গণী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ আল্লাহ পাকের একটি নাম মুবারক হচ্ছে ‘গণী’। অথচ স্বয়ং আখেরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উছমান যিন্‌ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুকে ‘গণী’ লক্বব বা উপাধী প্রদান করেন।

এখন প্রশ্ন হলো- তবে কি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উছমান যিন্‌ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুকে আল্লাহ বানিয়েছেন? (নাঊযূবিল্লাহ) আর হযরত উছমান যিন্‌ নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু ‘গণী’ লক্বব বা উপাধী ধারন করার কারণে আল্লাহ দাবী করেছেন? (নাঊযূবিল্লাহ)

আল্লাহ পাক নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম, আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামদের দ্বারা জগত পরিচালনা করে থাকেন। এটা আল্লাহ পাকের অক্ষমতা নয় বরং সম্মান মর্যাদার কারণ। যেমন আল্লাহ পাক সবকিছুই জানেন তারপরও ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামগণ বান্দার আমল সম্পর্কে আল্লাহ পাককে অবহিত করে থাকেন। এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ পাক জানেন না তাই ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামগণ অবহিত করে আল্লাহ পাক যে আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামদের দ্বারা জগত পরিচালনা করে থাকেন, তার প্রমাণ কুরআন শরীফ হাদীস শরীফেই রয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন,

“(জগতের) কার্য নির্বাহকারী।

(সূরা নাযিয়াত )

উক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থতাফসীরে খাযীনতাফসীরে বাগবীশরীফে উল্লেখ আছে,

“(কার্য নির্বাহকারী) হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, তাঁরা হলেন ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামগণ। ...... হযরত আব্দুর রহমান ইবনে সাবিত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, চারজন ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম জগতের কার্য নির্বাহ করে থাকেন। হযরত জিব্রাঈল, হযরত মীকাঈল, হযরত মালাকুল মউত আযরাঈল হযরত ইস্রাফীল আলাইহিমুস সালাম। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্সালাম ওহী, বাতাস সৈন্য পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। হযরত মীকাঈল আলাইহিস্সালাম বৃষ্টি, ফসল রিযিকের দায়িত্বে নিয়োজিত। হযরত মালাকুল মউত আযরাঈল আলাইহিস্সালাম রূহ কবয করার দায়িত্বে নিয়োজিত। হযরত ইস্রাফীল আলাইহিস্সালাম শিঙ্গায়ফুদেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত

কোন কোন তাফসীরে উক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিশেষ বিশেষ আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের হাতে বিশেষ বিশেষ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করার কথাও উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,

হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁরমসনদে আহমদশরীফে উল্লেখ করেন, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন ইরাকে অবস্থান করছিলেন তখন তাঁর সম্মুখে শামবাসীদের সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। লোকজন বললো, হে আমীরুল মুমিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! শামবাসীদের উপর বদদোয়া করুন। হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, না। কারণ আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘আব্দালগণ শামদেশেই থাকেন, তাঁরা সংখ্যায় ৪০জন। যখন তাঁদের মধ্যে একজন ইন্তেকাল করেন তখন আরেকজন দিয়ে সে স্থান পূর্ণ করা হয়। তাঁদের মাধ্যমে শামবাসী বৃষ্টি পেয়ে থাকে, শত্রুর উপর বিজয়ী হওয়ার জন্য সাহায্য পেয়ে থাকে এবং তাঁদের মাধ্যমে তারা আযাব-গজব থেকে বেঁচে থাকে।

প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ আছে যে,

হযরত ইমাম তিবরানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁরকবীরকিতাবে উল্লেখ করেন, হযরত উবাদা ইবনে ছামেত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে ৩০জন আব্দাল সর্বদাই থাকবেন। তাঁদের মাধ্যমে জমিন কায়িম থাকবে, তাঁদের মাধ্যমে মানুষ বৃষ্টি পাবে এবং তাঁদের মাধ্যমে মানুষ সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।

প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত আছে যে,

হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পৃথিবীতে এরূপ ৪০জন ব্যাক্তি (ওলী) সর্বদাই থাকবেন। যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহ পাক জমিনকে হেফাযত করবেন।

(হিলাইয়াতুল আউলিয়া)

অন্যত্র আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“তাঁদের মাধ্যমেই মানুষ বেঁচে থাকবে, মারা যাবে, বৃষ্টি পাবে, ফসল পাবে এবং বালা-মুছীবত দূর হবে।”

(হিলাইয়াতুল আউলিয়া)

প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে যে, হযরত মুয়ায বিন জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

“আব্দালদের মধ্য এমন ৩জন রয়েছেন যাঁদের মাধ্যমে দুনিয়া কায়িম থাকবে।”

(হিলাইয়াতুল আউলিয়া)

হযরত ক্বাতাদাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন,

“এরূপ ৪০জন লোক থেকে জমিন কখনো খালি থাকবেনা, তাঁদের মাধ্যমে মানুষ বৃষ্টি পাবে, সাহায্যপ্রাপ্ত হবে এবং রিযিকপ্রাপ্ত হবে।”

(হিলাইয়াতুল আউলিয়া)

প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ আছে,

“সমস্ত শহরেই ৭জন এরূপ ওলী থাকেন যাঁদের মাধ্যমে মানুষ বৃষ্টি লাভ করে, শত্রুর বিরুদ্বে সাহায্যপ্রাপ্ত হয় এবং তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ পাক জগতের কার্যসমূহ সম্পাদন করেন।”

(হিলাইয়াতুল আউলিয়া)

স্মর্তব্য যে, জগতখ্যাত আলিমে দ্বীন, সুলতানুল আরিফীন, মুজাদ্দিদুয্‌ জামান, ইমামুল মুহাদ্দিছীন, তাজুল মুফাস্‌সিরীন, হযরত ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্বখ্যাত ও সর্বজনমান্য কিতাব “আল হাবী লিল ফতওয়া”তে উল্লিখিত হাদীস শরীফসমূহ উল্লেখ করতঃ এটাই প্রমাণ করেছেন যে, জগতে অসংখ্য গাউছ, কুতুব, আব্দাল, আওতাদ, নক্বীব, নুজাবা, আখইয়ার তথা আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম আছেন, এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন, তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ পাক জগত পরিচালনা করে থাকেন। কেননা উল্লিখিত হাদীস শরীফসমূহে এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে,

(১) بِهِمْ يُغَاثُ النَّا سُ – তাঁদের মাধ্যমে মানুষ সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।

(২) تُنْصَرُوْنَ عَلَي الْعَدُوِّ - শত্রুর উপর বিজয়ী হওয়ার জন্য সাহায্যপ্রাপ্ত হবে।

(৩) يُدْ فَعُ الْبَلاَءُ وَالْعَذَابُ - তাঁদের উসীলায় বালা-মুছীবিত, আযাব-গজব দূর হবে।

(৪) يُحْيِيْ وَيُمِيْتُ - বেঁচে থাকবে ও মৃত্যু হবে।

(৫) يُنْبِتُ وَيُرْزَقُوْنَ - ফসল ও রিযিক পাবে।

(৬) يُحْفَظُ الْاَرْضُ - জমিন হিফাযত থাকবে।

(৭) تَقُوْمُ الْاَرْضُ - জমিন কায়িম থাকবে।

(৮) قَوَّمُ الدُّنْيَا - দুনিয়া কায়িম থাকবে।

(৯) يُقِيْمُ اَمْرَ الدُّنْيَا - জগতের কার্যাবলী সম্পাদিত হবে।

যাদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহান আল্লাহ পাক হযরত আউলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের হাতে জগত পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ওলীগণের মাধ্যমে জগত পরিচালনা করে থাকেন। ওলীগণ মহান আল্লাহ পাকের খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবেই জগতের কার্যসমূহ সম্পাদন করে থাকেন। অতএব, যাঁদের মাধ্যমে জগতের মানুষ সাহায্যপ্রাপ্ত হয় তাঁরাই “গাউছ”, আর গাউছদের মধ্যে যিনি তাঁর যামানায় প্রধান থাকেন তিনিই “গাউছুল আ’যম”। সুতরাং এ অর্থে এবং উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও শদীস শরীফসমূহের দৃষ্টিতে “গাউছুল আ’যম” উপাধী মাখলুকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

অতএব, উপরোক্ত বিস্তারিত ও দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, কোন মাখলুক সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী বা উদ্বারকারী হতে পারে না- এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণই কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফের খিলাফ। সাথে সাথে কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ ও অসংখ্য ছহীহ হাদীস শরীফ অস্বীকার করার নামান্তর। যা কাট্টা কুফরীর পর্যায়ভুক্ত।

এছাড়াও “গাউছুল আ’যম” লক্বব বা উপাধীটি শুধু হযরত আব্দুল ক্বাদির জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এরই নয়। অন্যান্য আরো বড় বড় ওলী আল্লাহরাও এই লক্বব ব্যবহার করতে পারেন। কেননা হযরত আব্দুল ক্বাদির জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মর্যাদা এই লক্বব পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। যেমন একবার তাঁর এক মুরীদ তাঁকে প্রশ্ন করলো আপনি কি মুজাদ্দিদুয্‌ যামান? তিনি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ। অতপর মুরীদ আবার প্রশ্ন করলো আপনি কি কুতবুল আলম? তিনি উত্তর দিলেন- হ্যাঁ। এভাবে সে মুরীদ মোট ৪টি লক্বব সম্পর্কে প্রশ্ন করলো, যার উত্তরে তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। ফলে মুরীদ বসে গেল, আর কোন প্রশ্ন করলো না। তখন তিনি মুরীদকে বললেন তোমার কি আর কিছু জানার নেই? মুরীদ উত্তর দিল- না। তখন তিনি বললেন, আমার মাক্বাম এরও উপরে, এরও উপরে, এরও উপরে, অরাউল অরা, অরাউল অরা, অরাউল অরা।

সুতরাং, যারা তাঁকে “গাউছুল আ’যম” পর্যন্তই সীমাবদ্ধ করবে তারা তাঁর সাথে চরম বেয়াদবি করবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে প্রত্যক ওলী আল্লাহর লক্ববগুলো তাঁর যামানার জন্যই খাছ।

(৩) নবী-রসূল মারা গেলে কোন ক্ষমতা থাকে না- এর উত্তরঃ

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হায়াতুন্‌ নবী

মহান আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ ফরমান,

যাঁরা আল্লাহ পাকের রাস্তায় শহীদ হয়েছেন তোমারা তাঁদেরকে মৃত বলো না, বরং তাঁরা জীবিত। অথচ তোমারা তা উপলব্ধি করতে পারছো না।

(সূরা বাক্বারা ১৫৪)

অর্থাৎ যাঁরা মহান আল্লাহ পাকের মতে পথে থাকতে গিয়ে তথা দ্বীন ইসলামের বিজয়ের লক্ষ্যে মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য জীবন দিয়েছেন বা শহীদ হয়েছেন, স্বয়ং আল্লাহ পাকই তাঁদেরকে জীবিত (اَحْيَاءُ) বলেছেন

আর ওলীআল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের শানেও বলা হয়েছে,

ওলীআল্লাহগণ মৃত্যুবরণ করেন না বরং তাঁরা অস্থায়ী জগত থেকে স্থায়ী জগতের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন।

(মিরকাত ৩য় খন্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা)

এছাড়াও আমভাবে সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণও স্বীয় রওজা মুবারকে জীবিত রয়েছেন। যেমন, কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে,

নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে তাঁর রওজা মুবারকে নামাযরত অবস্থায় দাঁড়ানো দেখেছেন। অনুরূপভাবে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকেও দেখেছেন।

(মিরকাত ৩য় জিলদ্‌, ২৪১ পৃষ্ঠা)

সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে,

হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ স্বীয় রওজা মুবারকে জীবিত থাকেন। তাঁরা রওজা মুবারকে নামাযও আদায় করেন।

(তারীখে ইস্পাহান /৮৩, ফয়জুল ক্বাদীর /১৮৪, আবূ ইয়ালা, দায়লামী ৪০৪)

শুধু তাই নয় বরং সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণই স্বীয় রওজা মুবারকে অবস্থান করে আল্লাহ পাকের ইবাদত-বন্দিগীতে মশগুল রয়েছেন এবং রিযিকও পাচ্ছেন। অন্য হাদীস শরীফে ইরশাদ করা হয়েছে,

হযরত আউস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাকের জমিনের জন্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের শরীর মুবারককে ভক্ষন করা (নষ্ট করা) হারাম করে দিয়েছেন।

(আহমদ, আবূ দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনু হিব্বান, মুস্তাদারিকে হাকিম, কানযুল উম্মাল, মিশকাত, মিরকাত)

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ করা হয়েছে,

সুতরাং আল্লাহ পাকের নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ স্বীয় রওজা মুবারকে জীবিত রয়েছেন এবং তাঁরা খাদ্যও খেয়ে থাকেন।

(ইবনে মাজাহ, মিশকাত, মিরকাত ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪১)

উপরোক্ত দলীলভিত্তিক আলোচনায় এটাই ছাবিত হলো যে, ওলীআল্লাহগণসহ শুহাদা--কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ এবং সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ স্বীয় মাযার শরীফ বা রওজা মুবারকে জীবিত রয়েছেন। তাহলে যিনি সমস্ত নবী আলাইহিমুস সালামগণের নবী, রসূল আলাইহিমুস সালামগণের রসূল; এমনকি সমস্ত কায়েনাতের নবী রসূল তিনি কি করে রওজা মুবারকে জীবিত নন? অবশ্যই তিনি রওজা মুবারকে জীবিত অবস্থায়ই রয়েছেন, কারণ তিনি হায়াতুন্নবী

সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে,

নিশ্চয়ই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওজা মুবারকে জীবিত অবস্থায়ই রয়েছেন

(মিরকাত ২য় খন্ড ২২৩ পৃষ্ঠা)

সম্পর্কে কিতাবে আরো উল্লেখ করা হয়েছে,

সুলতানুল আউলিয়া, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্তরীক্বত, হযরত শায়খ আবুল মাওয়াহেব শাযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, একবার আখেরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জিয়ারত নছীব হলো। তিনি নিজের সম্পর্কে বললেন, “আমি মৃত নয়। আমার পরলোক গমনের বিষয়টা এরূপ যে, যারা আল্লাহ পাক প্রদত্ত রূহানী ইল্ থেকে বঞ্চিত, আমি তাদের দৃষ্টির আড়ালে পরলোকবাসী। কিন্তু যারা আল্লাহ পাকের দেয়া রূহানী ইল্ রাখে তাদের মধ্যে আমি জীবিতই রয়েছি। আমি যেমন তাদের দেখতে পাই তেমনি তারাও আমার সাক্ষাত লাভ করা।

(তবক্কাতুল কুবরা)

অতএব, উপরোক্ত আলোচনায় এটাই প্রমাণিত হলো যে, আখেরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওজা মুবারকে জীবিত অবস্থায়ই রয়েছেন, কারণ তিনি হায়াতুন্নবী

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের দরূদ শরীফ, সালাম, দু’য়া ইত্যাদি শুনতে পানঃ

সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

যে ব্যক্তি আমার রওজা মুবারকের নিকটে এসে আমার প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করবে আমি অবশ্যই তার দরূদ শরীফ শুনতে পাই।

(বায়হাক্বী, মিশকাত ৮৭)

অন্য হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ করা হয়েছে,

“কোন ব্যক্তি যে কোন স্থানে বসে আমার প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করলে তার আওয়াজ আমার কানে পৌছে থাকে। হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুমগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার বিদায়ের পরেও কি? উত্তরে আল্লাহ পাকের হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার বিদায়ের পরেও এ হুকুম বলবত থাকবে।”

(জিয়াউল ইফহাম)

অন্য হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে,

হে আমার সাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ!, হে আমার উম্মতগণ! তোমারা আমার প্রতি প্রত্যক সোমবার শুক্রবার দরূদ শরীফ পাঠ করো। নিশ্চয়ই তোমাদের সে দরূদ শরীফ আমি বিনা মধ্যস্থতায় শুনতে পাই।

(জিয়াউল ইফহাম, আনিসুল জালীস)

উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে,

“(হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন) আমি হাক্বীক্বীভাবে বিনা মধ্যস্থতায় তা শুনতে পাই।

(মিরকাত ২য় খন্ড, ৩৪৭ পৃষ্ঠা)

হযরত আবূ সাদিক আজদিল কুফী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণনা করেন, আখেরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন। ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পবিত্র রওজা মুবারকে রাখার ৩দিন পর একজন গ্রাম্য লোক আসলেন। তিনি পবিত্র রওজা মুবারকের নিকটবর্তী হয়ে পবিত্র রওজা মুবারকের মাটি মুবারক স্বীয় মাথায় স্থাপন করতঃ বলতে লাগলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ! ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ‘আমি আমার নফসের উপর জুলুম করেছি, অতঃপর আপনার পবিত্র সান্নিধ্যে এসেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।তখন রওজা মুবারক থেকে বলা হলো, ‘নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করা হলো।’ (সুবহানাল্লাহ)

(তাফসীরে কুরতুবী, ৩য় খন্ড ২৬৫ পৃষ্ঠা)

হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফতকালে অনাবৃষ্টি দূর্ভিক্ষ দেখা দিলে হযরত বিলাল ইবনে হারিসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে তিনি বৃষ্টি প্রার্থনা করার জন্য রওজা মুবারকে পাঠিয়েছিলেন। হযরত বিলাল ইবনে হারিসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রওজা মুবারকে গিয়ে প্রার্থনা করলেন- “হে আল্লাহ পাকের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! লোকজন বৃষ্টির অভাবে ধ্বংস হবার উপক্রম হয়েছে। আপনি আল্লাহ পাকের নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করুন।স্বপ্নযোগে নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথে দেখা দিলেন এবং ইরশাদ করলেন- “তাদের জন্য বৃষ্টি হবে এবং উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলিও- শাসন কার্যে তিনি যেন একটু নরম হন।

(বায়হাক্বী)

হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের সমস্ত আমল দেখেনঃ

পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,

“(হে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি কি দেখেননি? আপনার প্রভূ আদ জাতির সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন।

(সূরা ফজর )

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,

আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফের এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমদের উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি যা কিছু দেখি তোমারও কি তা দেখো? হযরত সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ বললেন, জ্বি না। তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আমি পরবর্তীতে সংঘটিত ফিৎনাসমূহ বৃষ্টির ফোটার ন্যায় পড়তে দেখছি।

(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)

অর্থাৎ আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর অয়াক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হুজরা শরীফে অবস্থান করেও দূর-দূরান্তে যা কিছু ঘটতো বা ঘটবে তাও দেখতে পেতেন। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর অয়াক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সমস্ত সৃষ্টির প্রথমে নবী হিসেবেই সৃষ্টি হয়েছেন সেহেতু তিনি সৃষ্টিএ শুরু থেকে দুনিয়াতে বাহ্যিকভাবে তাশরীফ আনা বিছাল শরীফ পর্যন্ত সমস্ত দুনিয়ায় সংঘটিত সমস্ত কিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন দেখেছেন। প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ ফরমান,

“(হে নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি কি দেখেননি? আপনার প্রভূ হস্তিবাহিনীর সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন।

(সূরা ফীল )

আদ জাতির ধ্বংসের কাহিনী আল্লাহ পাকের হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সরাসরি জমিনে তাশরীফ আনার হাজার হাজার বছর আগেই সংঘটিত হয়েছে। আবার আবরাহা বাদশাহর হস্তিবাহিনীর ধ্বংসের ঘটনাও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সরাসরি জমিনে তাশরীফ আনার কিছুদিন পূর্বের। অথচ উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ পাক বললেন, “আপনি কি দেখেননি?” অর্থাৎ অবশ্যই আপনি দেখেছেন।

সুতরাং এ আয়াত শরীফদ্বয় দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাহ্যিকভাবে জমিনে তাশরীফ আনার পূর্বে আল্লাহ পাকের কায়িনাতে সংঘটিত সমস্ত কিছুই আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখেছেন।

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান,

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য সুপারিশকারী ও তোমাদের আমলের সাক্ষী। অবশ্যই তোমাদের সাথে আমার পরবর্তী সাক্ষাতের স্থান হলো হাউজে কাউছার যা আমি এ স্থানে অবস্থান করেই দেখতে পাচ্ছি।”

(বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)

আর যেহেতু তিনি হায়াতুন্‌ নবী ও হাযির-নাযির। তাই তিনি রওজা মুবারক থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত উম্মতের সকল আমল ও সমগ্র কায়িনাতে সংঘটিত সমস্ত কিছু সরাসরি দেখেন। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে,

“হযরত মিনহাল ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন, এমন কোন দিন নেই যার প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট স্বীয় উম্মতের আমল পেশ করা হয় না (দেখানো হয় না) তখন তিনি সকলের নাম ও আমলসহ দেখে সকলকে চিনতে পারেন। আর এজন্যই তিনি সকলের সাক্ষী হবেন।”

(মাফাহীম ২৫৮)

“হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক আমার নিকটে একজন ফেরেশ্তাকে মুক্বাররার করেছেন যার কাছে স্বয়ং আল্লাহ পাকই সমস্ত মাখলুকাতেররররর নাম দিয়েছেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত কোন মাখলুক যখনই আমার প্রতি একবার দরূদ শরীফ পাঠ করে তখনই সেই ফেরেশ্তা দরূদ শরীফ পাঠকারীর নাম ও তার পিতার নাম আমার সামনে পেশ করেন। অমুকের পুত্র অমুক আপনার প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করেছেন।”

(বাজ্জার, ইবনু হিব্বান, মাফাহীম ২৫৮)

“হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, আপনি কি তাদের দেখতে পান যারা দূর থেকে ও আপনার বিদায়ের পর (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) আপনাত প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করবে? আপনার নিকট এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য ইয়কি? উত্তরে আল্লাহ পাকের হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার প্রতি যারা মুহব্বতের সাথে ছলাত-সালাম পাঠ করে তা আমি সরাসরি শ্রবণ করি ও তাদেরকে দেখি ও চিনতে পারি। আর যারা মুহব্বত ব্যতীত পাঠ করে তাদের ছলাত-সালামও আমার কাছে পৌছানো হয়।”

(দালায়েলুল খইরাত)

আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,

“উম্মতের বিবিধ কর্মকান্ডের প্রতি দৃষ্টি রাখা, তাদের পাপরাশির ক্ষমা প্রর্থনা করা, তাদের বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করার জন্য দু’য়া করা, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত আনাগোনা করা ও বরকত দান করা এবং নিজ উম্মতের কোন নেক বান্দার ওফাত হলে তাঁর জানাযাতে অংশগ্রহণ করা- এগুলোই হচ্ছে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সখের কাজ। কোন কোন হাদীস শরীফ থেকে এসব কথার সমর্থন পাওয়া যায়।”

উপরোক্ত কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটাই ছাবিত হলো যে, আল্লাহ পাকের হাবীব, আউয়ালুল খালাইক্ব, হায়াতুন্‌ নবী, হু্যুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাকের কায়িনাতে সংঘটিত সমস্ত কিছু দেখেন, সব কিছু শুনেন এবং উম্মতের কল্যাণও করে থাকেন। সুতরাং যারা বলে-

“মানুষ মরে গেলে তার কোন ক্ষমতাই থাকে না হোক সে নবী-রসূল বা কোন বড় আলেম। সে তখন মূল্যহীন। মৃত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমনভাবে ভাবা ঠিক নয় যে তিনি আমাকে দেখছেন বা তিনি আমার কল্যাণ করতে পারবেন। এই ক্ষমতা জীবিত অবস্থায়ও তাঁর ছিল না আর মৃত অবস্থায় তো প্রশ্নই উঠে না, এবং কেউ এরকম মনে করে তাহলে সে স্পষ্ট শির্ক করবে।”

তাদের এই কুফরী উক্তিগুলো কি করে গ্রহনযোগ্য হতে পারে, বরং তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত হতে খারিজ হয়ে বাতিল ৭২ ফিরক্বার অনুসারী অর্থাৎ তারা ইবনে ওহাব নজদীর উম্মত।